নীল আকাশের মহাসাগরে যখন সাদা মেঘের ভেলা ভাসিয়ে দিত কেউ, শরৎ তার অরুণ আলোর অঞ্জলি দিয়ে ধানের খেতে রৌদ্রছায়ায় খেলতো লুকোচুরির খেলা, শিউলিবনের বুক উঠতো চঞ্চল হয়ে--- তখনই একদিন খবরকাগজে পাতাজোড়া পুজোয় চাই নতুন জুতো, আর শারদীয়া আনন্দমেলার আনকোরা নতুন বিজ্ঞাপনে প্রফেসর শঙ্কু বয়ে আনতেন দেবীপক্ষের প্রথম আলোর চরণধ্বনি।সেই মোলায়েম পূজো পূজো গন্ধ বাড়তে বাড়তে একসময় ম ম করতো চরাচর। স্কুল ঝাঁপ ফেললেই জলপাইগুড়ির বন্ধুমহল, সেজে ওঠা পাড়ার মন্ডপ, নিতাই পালের আস্তানায় অপরূপা মৃণ্ময়ী মাতৃপ্রতিমাদের ফেলে রেখে-- পর্যায়ক্রমে ট্রেন-বাস-গোযান বাহিত হয়ে, পঞ্চমী কি ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় পৌঁছে যেতাম বর্ধমান থেকে গোটা তিরিশ কি.মি. দূরে নারায়ণপুর গ্রামে।আরও পড়ুনঃ শারদঅর্ঘ্যপরের চারদিন কোথা দিয়ে যে কেটে যেত আরতি-অঞ্জলি-পূজো-প্রসাদের পৌনঃপুনিকতায়! গ্রামের গুটিকয় বন্ধুর সাথে সেরে ফেলতাম ফেলে আসা বারো মাসের সালতামামি; আর এই সব করতে করতেই কোথা দিয়ে পূজো শেষ। ঢাকিরা বোল তুলত -- ঠাকুর থাকবি কতক্ষণ ঠাকুর যাবি বিসর্জন! দশমীর নিশুতি রাতে বিসর্জনের পর বুকটা সত্যি খাঁ খাঁ করতো অজয় নদের শূণ্য চরের মতো, খেতে বসে বার বার ঢোঁক গিলে সামলে নিতাম উপচে আসা চোখের জল।বড় হয়ে পূজো শেষের এই মনখারাপটা কেটে গেল। মনকে সহজেই বোঝাতে পারতাম-- মা তো যাননি কোথাও; আছেন তো সারাক্ষণ আমার পাশেই!তুমি যে চেয়ে আছো আকাশ ভরে,নিশিদিন অনিমেষে দেখছো মোরে...চলমান জীবনের প্রতি পলে আজ অনুভব করি তাঁর কল্যাণময়ী স্পর্শ। মণ্ডপের মৃণ্ময়ী মাতৃমূর্তি চিন্ময়ীরূপে অনুক্ষণ আচ্ছন্ন করে রাখেন চেতন ও মনন।আরও পড়ুনঃ বাজলো তোমার আলোর বেণুপূজো আসে, পূজো যায়..... ২০০২ -এ তিস্তা এলো আমাদের ঘরে। তার পৃথিবীর আলো দেখার আগে নানা জটিলতার জন্য চারবার আল্ট্রাসনোগ্রাম করতে হয়েছিল রূপার; কিন্তু আগেভাগে অনাগত সন্তানের লিঙ্গ জেনে ফেলতে ব্যাকুল হইনি আমরা কেউই। মেয়ের মুখ প্রথম দেখার শুভক্ষণটি মনে হয়েছিল জীবনের সেরা মুহূর্ত, যে স্বাদের ভাগ হবে না কোন দিনও!পূজোমন্ডপ হরগৌরীতলায় হামাগুড়ি দিয়ে... হোমের কৃষ্ণতিলক হাতের তেলো দিয়ে কপালময় লেপে নিয়ে... বাবার কাঁধে চড়ে বিসর্জনের শোভাযাত্রায় সামিল হয়ে... ঢাকের গায়ে ছোট্ট হাতের এলোমেলো চাঁটি মেরে... নবমীর দুপুরে হোমাগ্নির ধোঁয়ায় চোখ কচলে লাল করে... ভোরের শিউলি বিছানো গাছতলায় ফুল কুড়িয়ে মালা গেঁথে, একটু একটু করে পাপড়ি মেললো আমার ছোট্ট তিস্তা।আরও পড়ুনঃ তোমাদের মনের মতো রঙীন পূজাবার্ষিকী-- আনন্দমেলাসন্ধ্যারতির সময়, ঢাক-কাঁসর-ঘণ্টা-সানাই-র ঐকতানে, ফুলের মালা-দীপের আলো-ধুপের ধোঁয়ার প্রেক্ষাপটে, আত্মজার মধ্যে যেন আজ ফুটে উঠতে দেখি জগন্মাতার অগ্নিময়ী রূপকল্পেরই এক প্রোজ্জ্বল খন্ডাংশ। মনে হয় মা উমা যেন ঘরের মেয়েটি হয়ে খেলে বেড়াচ্ছেন আমাদের ছোট্ট ঘরে। শরনাগতদীনার্তপরিত্রাণপরায়ণা সর্বস্যার্তিহরা দেবী নারায়ণী যেন ভালবাসার টানে আলো করছেন আমাদের আতুর আঙিনা.... তাই তোমার আনন্দ আমারপর, তুমি তাই এসেছ নীচে....আরও পড়ুনঃ পুজো শুরু হয়ে গেলঅবাক হয়ে দেখি, কাকতালীয়ই হবে নিশ্চয়, আমার স্কুল-কলেজ-কর্মস্থলের বেশীর ভাগ সমবয়সী বন্ধুরই ঘর আলো করছে এক একটি কন্যাসন্তান। তাদের মেয়েবেলার উজ্জ্বল সংকেত ভেসে আসে আন্তর্জালে। এদের সব্বার মধ্যে জ্যোতির্ময়ী মহামায়ার পরমা শক্তির উদ্বোধন হোক, মেধা-প্রতিভা-সাফল্যের পবিত্র হুতাশনে পূব আকাশ উঠুক রাঙা হয়ে!লেখকঃ ডঃ সুজন সরকারবর্ধমান।