গ্রামীণ ভারতে গরীব মানুষের জীবন, জীবিকা ও অর্থনীতি পরিব্রাজনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে সম্পর্ক যুক্ত। ছদ্ম বেকারত্ব ও অর্থনৈতিক দুর্বলতার চাপে অনন্যোপায় হয়ে আন্তঃরাজ্য পরিব্রাজনই হয়ে ওঠে তাদের বেঁচে থাকার একমাত্র জীয়ন কাঠি। গ্রাম থেকে শহরে কাজ করতে গরীব মানুষের যাওয়াটা নতুন কিছু নয়, চিরন্তন কাল ধরেই সেটা হয়ে এসেছে। কিন্তু যেটা নতুন তা হল নব্য-উদারবাদের ভারতে তার সংখ্যাটা। পরিযায়ী শ্রমিকদের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে গত শতাব্দির নব্বই এর দশক থেকে বাড়তে শুরু করে ২০১১ সালে দাঁড়ায় প্রায় ৪৫ কোটি যা দেশের মোট জনসখ্যার ৩৭ শতাংশ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির নিরিখে ২০২১ সালে যা আনুমানিক ৫৫ কোটিতে পৌঁছনোর কথা। প্রয়োজনীয়তা বা পছন্দের দ্বৈত কারণে গ্রামের গরীব মানুষের একমাত্র উপায় হলো বছরের বিভিন্ন সময় চক্রাকার বা ক্ষণস্থায়ী আন্তঃরাজ্য পরিব্রাজন। এত দিন সব মোটের উপর ঠিকঠাক চলছিল। বাদ সাধল অতিমারি, যাদের আমরা কোনওদিন দেখতে পেতাম না, তারা এখন দৃশ্যমান। কাতারে কাতারে ঝকঝকে ভারতের সুবর্ণ চতুর্ভুজ ধরে হাঁটছে এবং মরছে। আমরা তো জানতামই না, লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক কি ভাবে শহরের অসংগঠিত অর্থনীতিকে সচল রেখে ছিল তা না কী দেশের সরকারও জানত না। আসলে তারা ছিল, ঠিক প্রদীপের তলায় যেমন অন্ধকার থাকে বড় বড় শহরের ঘিঞ্জি বস্তিতে বা অস্থায়ী ছাউনিতে। তাদের আমরা এখন ফিরে আসতে দেখছি, কিন্ত জানি কী তারা গিয়েছিল কী ভাবে? কে নিয়ে গিয়েছিল তাদের। না জানি না, কারণ যারা নিয়ে গিয়েছিল, তারা কিন্তু অদৃশ্য। তারা শ্রমিক ঠিকাদার বা শ্রমিকদের নিজের ভাষায় দালাল। পরিযায়ী শ্রমিক নির্ভর অসংগঠিত অর্থনীতির মূল তিনটি স্তম্ভঃ পরিযায়ী শ্রমিক, পূঁজিবাদী মালিক বা শিল্পপতি এবং এই দুই পক্ষের মাঝখানে সংযোজক হিসেবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন স্তম্ভ হল শ্রমিক ঠিকাদার বা দালাল।তাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে পরিযায়ী শ্রমিকদের শোষণ যন্ত্রনার কথা বুঝতে গেলে নব্য-উদারবাদের ভারতে শ্রমিক ঠিকাদারদের ভূমিকার পর্যালোচনা জরুরি। দিল্লি, কেরালা, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশে সহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে সারা বছর ধরে অসংগঠিত শ্রমিকদের চাহিদা থাকে তুঙ্গে। তাই কম খরচে কোনওরকম ঝুঁকি না নিয়ে এমনকি শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতন ও অধিকারকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এই পরিযায়ী শ্রমিকদের জোগান ও সরবরাহ বিভিন্ন দেশী-বিদেশী সংস্থার কাছে বেশ লাভজনক একটি ব্যবস্থা। আর এখানেই পারস্পারিক বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে গ্রামে গ্রামে শ্রমিক ঠিকাদার বা দালালদের আবির্ভাব ঘটে। খাদ্য, বস্ত্র বাসস্থান সহ দৈনন্দিন সামাজিক চাহিদা মেটাতে ও বিনা সুদে টাকা ধার সহ কাজ জোগানোর ক্ষেত্রে ঠিকাদারদের জুড়ি মেলা ভার। সংবিধান প্রদত্ত কাজের অধিকারের কথা যতই বলি না কেন টালমাটাল অবস্থায় জীবন জীবিকার সংকটময় সময়ে এই ঠিকাদারের ভূমিকা গ্রামের মানুষের কাছে ত্রাতার থেকে কোনো অংশে কম নয়। তাই টাকা ধারের ক্ষেত্রে মহাজনদের মাত্রাতিরিক্ত সুদ এড়াতে তারা ঠিকাদারদের কাছে অগ্রিম টাকা ধার নেয়। শর্ত একটাই চাষের কাজ শেষ হলে ভিন রাজ্যে পরিব্রাজন ও দিন মজুর হিসাবে কাজে নিযুক্তি। প্রথমবার শ্রমিকদের সঙ্গে গন্তব্যে গিয়ে তারা শ্রমিকদের শহরের ঠিকাদারদের হাতে সঁপে দিয়ে গ্রামে ফিরে আসে।পরিযায়ীদের অনেকেরই ব্যাংক একাউন্ট না থাকায় এরা রোজগারের টাকা এই সমস্ত ঠিকাদারদের মাধ্যমে বাড়িতে পাঠানোর চেষ্টা করে। সেক্ষেত্রে কিছু টাকা কেটে নিয়ে বাকি পাঠানো টাকা ঠিকাদাররা পরিযায়ী শ্রমিকদের বাড়িতে পৌঁছে দেয়। সংকটের সময় দরকার হলে ঠিকাদাররা পরিযায়ীদের বাড়িতে টাকা সাহায্য করে পারস্পরিক বিশ্বাস ও নির্ভরতার পরিবেশ তৈরি করে তাদের লাভের তাগিদে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই ধরনের ঠিকাদাররা হয় সেই গ্রামের অথবা নিকটবর্তী গ্রামের বাসিন্দা। কখনও কখনও অভিজ্ঞ পরিযায়ীদের মধ্যে কেউ কেউ আবার ঠিকাদারে পরিণত হয় শহরে তাদের নিজস্ব চেনাজানার নেটওয়ার্ক তৈরি হলে। সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় যখন প্রাপ্য টাকা এবং শেষ পর্যন্ত যা পরিযায়ীদের হাতে আসে তার মধ্যে বিস্তর ফারাক হয়। এছাড়া নুন্যতম সুরক্ষা সরঞ্জাম, অসুস্থকর পরিবেশে থাকা, কোম্পানির বৈধ কাগজপত্রের অভাব যাতে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে সহজে চাপা দেওয়া যায় এসব তো আছেই। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো Inter State Migrant Workmen Act 1979, অনুসারে শ্রমিক শোষণ প্রতিরোধে সঠিক নথিভুক্তি করন, ঠিকাদারদের লাইসেন্স, পরিবহণ ভাতা সহ একাধিক নিয়ম নীতির কথা বলা হলেও বাস্তবে এসব খুঁজে পাওয়া মুস্কিল। একবার পরিযায়ীরা বাইরে গিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলে পরবর্তী কালে তারা সেই ঠিকাদারদের অধীন কাজে যেতে অরাজি হন। কিন্তু পারিবারিক দায়বদ্ধতার কথা ভেবে যাওয়া বন্ধ করতেও পারেন না, শুরু হয় বিকল্প ঠিকাদারের সন্ধান। আবার কিছু অগ্রীম টাকা, একটু সুযোগের প্রলোভন এবং একসঙ্গে কমদিনে বেশ কিছু টাকা উপার্জনের সুযোগ বেকার পরিযায়ীরা ঠেলে দিতে পারেন না। এভাবেই দিনের পর দিন চলতে থাকে পরিব্রাজনের ফাঁদ, যার থেকে দুর্ভাগ্যবশত নিজেদেরকে দূরে রাখতে পারাটা মুশকিল। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো আমাদের দেশে পরিযায়ীদের সংখ্যা, তাদের অবস্থান, প্রকৃতি, কাজে যাবার প্রবণতা ইত্যাদির সঠিক সরকারি হিসাব না থাকলেও এই সমস্ত ঠিকাদার ও তাদের মালিক দের কাছে যে যথেষ্ঠ নির্ভরযোগ্য তথ্য রয়েছে বললে খুব একটা অতিরঞ্জিত হবে না। অনেকটা পুরীর পাণ্ডাদের মত। শারীরিক নিপীড়ন, অধিক সময় ধরে কাজ করানো, দৈহিক অত্যাচার, রোগগ্রস্ত হওয়া এবং তার ফল স্বরূপ অর্জিত মজুরীর অনেকাংশ ব্যয় এসবের ফলে পরিব্রাজনের মূল্য ও লাভের অঙ্কে শেষ পর্যন্ত পড়ে থাকে সামান্যই অবশিষ্ট।কোভিড অতিমারির প্রভাবে দেশ জুড়ে পরিযায়ীদের অস্থি মজ্জায় জর্জরিত নির্মম অবস্থার কথা আজ সবার জানা। ভারতের মোট জিডিপির প্রায় দশ শতাংশ প্রত্যক্ষ ভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় এই পরিযায়ীদের দ্বারা। ILO-এর সমীক্ষা বলছে সম্ভবত ভারতের প্রাই চল্লিশ কোটি মানুষ গ্রামে ফিরে এসে দারিদ্রতার শিকার হবেন। কিন্তু প্রশ্ন হল এই অবস্থার দায় কার? রাষ্ট্রের দায়িত্ব কতটা ছিল বা কতটা হওয়া উচিত ছিল সেই নিয়ে অনেক যুক্তি তক্ক চলছহে। কিন্তু রাষ্ট্র কে বাদ দিয়ে যারা এই শোষণ যন্ত্রের আড়ালে থেকে এই ব্যাবস্থা কে ছদ্মবেশে অল্প শিক্ষিত অভাবী ঠিকাদারদের দ্বারা পরিচালনা করে এতদিন নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত ছিলেন তারা কোথায় গেলেন? মনে রাখতে হবে যে এই বিপুল সংখ্যার পরিযায়ী মানুষ যদি পরিব্রজনের প্রচলিত ব্যাবস্থার প্রতি মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে আগামী দিনে তা শিল্পপতিদের জন্য খুব একটা সুখকর হবে না। মালিক এবং ঠিকাদার পক্ষ ভালো করেই জানে দেশে করেনা অতিমারির প্রকোপ কমলেই ওরা আবার শহরে আসতে বাধ্য হবে। আপাত ভাবে দেখলে মনে হবে মাইলের পর মাইল হেঁটে ফেরা পরিযায়ীদের অনেকেই আর এ জীবনে ফিরতে চাইবে না। কিন্তু যে দেশে মোট কর্মক্ষম জনসংখ্যার প্রায় তিরানব্বই শতাংশ মানুষ এখনো অসংগঠিত ক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত সেখানে সত্যিই কি এই বিপুল সংখ্যক মানুষের গ্রামে কাজ পাওয়া সম্ভব নয়। অতএব কিছু দিনের অপেক্ষার পর আবার গরীব মানুষদের বিশ্বাস অর্জনের পালা শুরু হবে ঠিকাদারদের গ্রাম ও শহর উভয় জায়গাতেই এবং পরিব্রাজনের দুষ্ট চক্রের মাধ্যমে কোনও নতুন রূপে হয়ত শ্রমিক শোষণ চলতেই থাকবে।ডঃ কুণাল চক্রবর্তীসহকারী অধ্যাপকশম্ভুনাথ কলেজ, লাভপুর,ওপ্রফেসার গোপা সামন্তভূগোল বিভাগবর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়