মহাষষ্ঠী অতিক্রান্ত করে আজ সকালে নবপত্রিকা স্নানের মধ্য দিয়ে পারিবারিক প্রথা মেনে বর্ধমানে সেরা বনেদী বড়ির শিরোপা জয়ী দাস বাড়ির পুজো শুরু হল। পরিবারের সকল সদস্যরা বাড়ি থেকে নবপত্রিকা নিয়ে বর্ধমান শহরের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বাঁকা নদীর ক্ষেত্রপাল ঘাটে যান। সেখানে পুজো পাঠ এবং শঙ্খ ও উলুধ্বনির মধ্যে দিয়ে নবপত্রিকা স্নান করান পরিবারের উত্তর পুরুষ শিব শঙ্কর দাস। এরপর দুর্গামন্দিরে এনে বিশেষ পুজোর পর নবপত্রিকাকে নতুন বস্ত্র পরিধান করিয়ে শুরু হয় মহাসপ্তমীর পুজো।
আধো ঘুমের মধ্যে ঢ্যাম কুড়কুড় ঢাকের আওয়াজ কানে আসছিল অনেকক্ষণ ধরেই, শেষ পর্যন্ত চোখ খুলতেই হোলো। আধখোলা জানালার ওপারে ফর্সা আকাশ... সামান্য ফুরফুরে হাওয়া... মনে পড়ে গেল আজ সপ্তমী --- সাড়ে ছটার মধ্যে স্নান সেরে তৈরী হয়ে নেওয়া চাই, সোয়া সাতটায় কলাবউ স্নান করিয়ে ঘট আনতে যেতে হবে।দাঁত মাজা ... মুখ ধোওয়া... বাথরুমে চার পাঁচ মগ জল ঢেলে কাকস্নান ... তারপর নতুন কাপড় পড়ে নিয়ে সোজা চাতোর-এ। চাতোর হোলো চত্বর-এর অপভ্রংশ, আমাদের পারিবারিক পুজোর ঠাকুরতলা ও সংলগ্ন খোলা জায়গাটুকু। শতাব্দীপ্রাচীণ এক বিরাট অশ্বথ্থ গাছের ছায়ায় (আমার নব্বই-ছুঁইছুঁই বাবাও শৈশবে একে এই চেহারাতেই দেখেছেন) এই দেবীমন্ডপে মা হরগৌরী পূজিত হয়ে চলেছেন --- ঠিক কত বছর কেউ জানে না, শদুয়েক বছর আগে পর্যন্ত পাওয়া গেছে লিখিত প্রমাণ।আরও পড়ুনঃ শারদঅর্ঘ্যসবুজ-গোলাপী কাঠের পালকি ( এরও বয়সের গাছপাথর নেই , কারণ আমি জ্ঞান হওয়া ইস্তক ঠিক এমনটিই দেখছি একে) পুকুরে চুবিয়ে এনে নামানো হয়েছে মন্ডপের সামনে। পাড়ার দুই কিশোর স্নান সেরে ফর্সা কাপড়ে গামছা-সহ তৈরী তাকে কাঁধে নিতে। আমার কৈশোরে বছর ছয়েক আমিও বাহক হয়েছি এই চতুর্দোলার। এক প্রজন্ম থেকে দোলা বওয়ার দায়িত্ব বর্তাচ্ছে পরের প্রজন্মে, যুগ যুগ ধরে।নানা বয়সী কাকীমা-মাসিমা-বৌ-ঝি-কাচ্চাবাচ্চায় জমে উঠেছে চাতোর। পুরোহিত বুড়োদা ও তন্ত্রীধারক নুপুরদা ধরাধরি করে কলাবউকে শুইয়ে দিল দোলায়। তারপর ঢাকের বাদ্যি আর কাঁসরঘন্টার ঝনঝনাৎকারের মধ্যে রওনা হলাম সবাই --- শুরুতেই ধুনুচি হাতে এক দাদা, তার পর পালকিতে কলাবউ, তার পিছে আম্রপল্লবসহ শূণ্য পিতলের কলসী কাঁখে আমরা তিনজন, পিছু পিছু বাজনদার-পুরোহিত-ছেলেমেয়ে-এঁড়িগেঁড়ির দল।আরও পড়ুনঃ বাজলো তোমার আলোর বেণুগ্রামের পথে সাতসকালের এই শোভাযাত্রা এঁকেবেঁকে এগিয়ে চললো কারো সাষ্টাঙ্গ প্রণাম, কারো জোড়হাতের নমস্কার নিতে নিতে। মাঝপথে সিংহবাড়ির মন্ডপের সামনে থেমে গিয়ে পালকিতে তুলে নেওয়া হোলো তাঁদের কলাবউকেও। পদযাত্রা শেষ হোলো গ্রামের মাধ্যমিক স্কুলের পাশে বাঁধাপুকুরে গিয়ে।পুরোনো দিনে গ্রামের পানীয়জল ও পুজোর ক্রিয়াকর্মের জন্য ব্যবহৃত হতো এই চতুষ্কোণ পুকুরটি; একমাত্র এটিতেই ছিল শাণবাঁধানো ঘাট --- তাই এর নাম বাঁধাপুকুর। ঘাটের শানে পালকি ও ঘট নামানো হোলো; কলাবউ ও পুজোর সামগ্রী নিয়ে চার পুরোহিত নেমে গেলেন হাঁটুজলে; চলতে লাগলো মন্ত্রোচ্চারণ; ধুনুচির ধোঁয়া পাক খেতে খেতে উঠতে লাগলো উপরপানে।বাজিয়ে-রা ঢাক মাটিতে নামিয়ে হাঁফ ছাড়ছে, ঘাম শুকোচ্ছে গামছা নেড়ে নেড়ে। মাঝবয়সী পুরুষেরা চেয়ে আছে পুজোপাঠের দিকে, কেউ কেউ ধোঁয়া ওড়াতে শুরু করেছে ইতিমধ্যেই। কুচোকাঁচাগুলো বেশীরভাগই বেঢপ মাপের রঙবেরঙের পোশাকে ছুটোছুটিতে মত্ত ... খেলনাপিস্তলে ক্যাপ ফাটছে চটরপটর... একটু বড় মেয়েরা চুড়িদার-স্কার্ট-ঘাগরা সামলাতে ব্যস্ত... চড়া লিপস্টিক-ঝুটো গয়না-শিরোভূষণে গরবিনী... কারো কারো চোখে রহস্যময়ী হাসির ঝিলিক.... নবীন কিশোরের দল জটলা করে আছে একটু দূরে, তাদের মনোযোগ মূলতঃ এদিকপানেই...আরও পড়ুনঃ তোমাদের মনের মতো রঙীন পূজাবার্ষিকী-- আনন্দমেলাবাঁধাপুকুর থইথই করছে; সেই আটাত্তরের বন্যার পর এতো জল দেখি নি আর কখনো। দফায় দফায় প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে এবার, ঘাটের প্রথম পৈঠে অবধি ডুবে আছে তাই। চারদিক সবুজে সবুজ; কচুরিপানা-পাতাঝাঁঝি-শাপলা-ঢোলকলমীরা দখল নিয়ে নিয়েছে অনেকখানি জলের। দুটো শালুক ফুটে রয়েছে খুব কাছেই। আর পাতাঝাঁঝির ছোটো ছোটো সাদা ফুলে সমাচ্ছন্ন ঘাটের সামনেটা। ভীমরুল-মৌমাছি-প্রজাপতি ঘুরছে ফুলে ফুলে; জল ছুঁয়ে ছুঁয়ে উড়ছে লাল-হলুদ-নীল জলফড়িং। পুকুরের ওপাশে ভেসে আছে জলচর পাখি অনেকগুলো। কটা ফিঙে আর বাঁশপাতি উড়ছে ফরফরিয়ে। জলের ওপর জেগে থাকা শুকনো ডালে এত কলরবের মধ্যেও অটল স্থৈর্যে বসে আছে উজ্জ্বল নীল একটা মাছরাঙা।এইসব দেখছি, আর চোখ চলে যাচ্ছে পুকুরের পাশে একটা পাকুড়গাছের দিকে। একসময় ঐ গাছটি নাকি এ গ্রামের প্রিয় আত্মাহুতিস্থল ছিল--- অনেক মানুষ (তার মধ্যে ছোটোবেলায় দেখা আমাদের এক পুরোহিতঠাকুরও ছিলেন) ঐ গাছের ডাল থেকে ঝুলে পড়ে ভবসংসারের মায়া কাটিয়েছেন। ওঁরা কি দেখছেন, অদৃশ্য থেকে, আজকের এই প্রাণের মেলা?এসবের মধ্যেই পুজোপাঠ শেষ। কলাবউরা উঠে এলেন পালকিতে; পেতলের কলসিতে জল ভরে নিয়ে আম্রপল্লব স্থাপন করে মাথায় তুলে নেওয়া হোলো। গামছার ওপর ভারী কলসি সামলাতে সামলাতে পা মেলালাম পদযাত্রায়। ঠাকুরপুকুরের পাশ দিয়ে, পথের পাশে ঘাস চিবোতে থাকা গরু-ভেড়া-ছাগলদের কৌতুহল উদ্রেক করে, নবপত্রিকা চললেন মন্ডপের দিকে। পথের ওপর ভীষণ মন খারাপ করে শুয়ে বসে থাকা নেড়িগুলো সচকিত হয়ে ছুটলো সামনে সামনে। বাগ্দীপাড়ার মুখে দুটি বৌ পথে জলের ঘটি রেখে উপুর হয়ে প্রণাম করলো কলাবউদের--- এই ক্ষণিকের বিরতিটুকু ছাড়া চতুর্দোলা ফিরে এলো তরতরিয়ে।পুজো শুরু হয়ে গেল।লেখকঃ ডঃ সুজন সরকারবর্ধমান।
সপ্তমীর সকালে কলকাতা সহ দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় শুরু হয়েছে হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টিপাত। এদিন সকাল থেকেই আকাশের মুখ ছিল ভার। যে ক জন হাইকোর্টের নির্দেশ মেনে সকাল থেকেই ঠাকুর দেখতে বেড়িয়েছিলেন , এই বৃষ্টির জেরে তারাও ভীষণভাবে বাধার সম্মুখী্ন হলেন। শেষে কো্নও উপায় না পেয়ে ছাতা হাতেই মণ্ডপে হাজির হয়েছেন অনেকে। আরও পড়ুনঃ গভীর নিম্নচাপ , পুজো কমিটিগুলিকে সতর্ক থাকতে নির্দেশ মুখ্যমন্ত্রীর প্রসঙ্গত , মধ্য বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের কারণে আগেই পুজোয় বৃষ্টির সম্ভাবনার কথা জানিয়েছিল হাওয়া অফিস। বলা হয়েছিল, ষষ্ঠী-সপ্তমী প্রবল বৃষ্টি হবে দক্ষিণবঙ্গে। বঙ্গোপসাগরে তৈরি হওয়া ওই নিম্নচাপের অভিমুখ ছিল অন্ধ্রপ্রদেশ উপকূল। পরে তা অভিমুখ পরিবর্তন করে। আরও শক্তি বাড়িয়ে গভীর নিম্নচাপে পরিণত হয়ে ওড়িশা-পশ্চিমবঙ্গ উপকূল হয়ে বাংলাদেশের দিকে এগোতে থাকে। যত পশ্চিমবঙ্গ উপকূলের কাছাকাছি আসে ততই গভীর নিম্নচাপে পরিণত হতে থাকে। এর জেরেই এদিন বৃষ্টির পাশাপাশি সমুদ্র উত্তাল হওয়ার সম্ভাবনাও প্রবল।