মানস ভট্টাচার্য
২০০৮-এর ডিসেম্বর। প্রথম কলকাতা সফরে মহেশতলায় মারাদোনা! কোচিংয়ে সফল না হলেও যাঁর ক্রীড়াশৈলীতে মুগ্ধ হয়ে আমিও তাঁকেই ফুটবলের ঈশ্বর মানি। মঞ্চে তাঁর দু-পাশে ছিলাম আমি আর কৃষ্ণেন্দু রায়। মারাদোনার প্রয়াণের খবর পেয়ে প্রতি মুহূর্তে সেই দিনের কথাগুলো মনে পড়ছি। শিহরণ জাগে। আছে আক্ষেপ। কেন? তখন যাঁরা মারাদোনাকে এনে তাঁর পায়ের ছাপ নিয়ে শিলান্যাসের মাধ্যমে স্টেডিয়াম তৈরির ঘোষণা করেছিলেন, জমি দেখিয়ে টেন্ডার হয়েছিল, তারপরও সেখানে ফুটবল প্রতিভার বিকাশে স্টেডিয়ামটি কেন হলো না, তা নিয়ে মহেশতলা, বাটানগরের মানুষের মতো আমারও ধোঁয়াশা আছে। মারাদোনাকে ঘিরে আবেগ কাজে লাগিয়েও কি তখন তাঁকে যোগ্য সম্মান দেওয়া হয়েছিল? এমনকী সেই মারাদোনার পায়ের ছাপ, যা আজ দুর্লভ সংগ্রহ, সেটারও হদিশ নেই। নিশ্চয় সেটা কেউ ব্যক্তিগত সংগ্রহে রেখেছেন। আবেদন, আজ সেটিকে সামনে এনে অন্তত মারাদোনাকে মর্যাদা দিন।
আরও পড়ুন ঃ প্রয়াত দিয়েগো মারাদোনা, শোকার্ত ফুটবল বিশ্ব
মারাদোনা মঞ্চে বসে। তাঁকে নিয়ে গান বাজছিল। দোভাষীর মাধ্যমে গানের অর্থ বুঝে তিনি আপ্লুত হয়েছিলেন। অবাকও হয়েছিলেন। যে দেশে তিনি প্রথম এলেন সেখানেও তাঁকে ঘিরে এত উন্মাদনা! হবে না-ই বা কেন? বিরাশি থেকে চারটি বিশ্বকাপ খেলেছেন। কার্যত একার কাঁধে জিতিয়েছেন ছিয়াশির বিশ্বকাপ। নব্বইয়েও দলকে ফাইনালে নিয়ে গিয়েছিলেন, রেফারির বিতর্কিত পেনাল্টি আর্জেন্টিনার তথা মারাদোনার দ্বিতীয় বিশ্বকাপ জয়ের পথে বাধা হয়ে না দাঁড়ালে ফুটবল ইতিহাস অন্য খাতে বইত। চুরানব্বইয়ের বিশ্বকাপে আগাগোড়া তাঁকে চক্রান্ত করে হেনস্থা করা হয়। অনেকে পেলের সঙ্গে মারাদোনার তুলনা করেন। এটা ঠিক, পেলে তিনবার বিশ্বকাপ জিতেছেন, মারাদোনা একবার। কিন্তু পেলের পাশে যেসব প্লেয়াররা ছিলেন তাতে বিশ্বকাপ না জেতাটাই ছিল আশ্চর্যের। মারাদোনার পাশে সে তুলনায় কেউ ছিলেন না? একার কাঁধে দেশকে বিশ্ব ফুটবলে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন। এটাও ঠিক, বিরাশির ওই সময় অবধি ফুটবল মহলে জনপ্রিয়তায় পেলের ধারেকাছে কেউ ছিলেন না। আমি নিজেও পেলের বিরুদ্ধে খেলার সুযোগ পেয়েছি কলকাতায়। কিন্তু অস্বীকারের উপায় নেই, সেই জনপ্রিয়তায় ভাগ বসিয়ে বিপুল সংখ্যক ফ্যান বেস তৈরি করে ফেলেন মারাদোনা, তাঁর জন্যই আজও বহু ফুটবল ভক্ত আর্জেন্টিনার সাপোর্টার। ইতালির লিগ এমনিতেই কঠিন। সেখানে নাপোলিকে দ্বিতীয় ডিভিশন থেকে দেশের শীর্ষে নিয়ে যাওয়াও কম বড় ব্যাপার নয়। একার ক্যারিশমা, দক্ষতায় দেশ বা ক্লাবকে যেভাবে একা তিনি টেনে নিয়ে গিয়েছেন তার তুলনা হয় না।
মারাদোনাকে চিরকাল খাটো করে দেখিয়েছে আমেরিকা, ব্রিটিশরা। মারাদোনার আর্জেন্টিনার সঙ্গে ইংল্যান্ডের ফুটবল মাঠের যুদ্ধেও তো বারবার জড়িয়ে দেওয়া হয় ১৯৮২-র ফকল্যান্ড যুদ্ধের কথা। ফকল্যান্ড যুদ্ধে ব্রিটিশদের কাছে আর্জেন্টিনার হারের মধুর প্রতিশোধ হিসেবে দেখানো হয় ছিয়াশির বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনার কাছে ইংল্যান্ডের পরাজয়কে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমে মারাদোনার মৃত্যুর পরও বারবার দেখানো হয়েছে ছিয়াশির বিশ্বকাপের সেই হ্যান্ড অব গড। কেন তারপরেই পাঁচ ফুটবলারকে কাটিয়ে ওই ম্যাচে মারাদোনার দ্বিতীয় গোলটি, যা ফিফার বিচারে শতাব্দীর সেরা গোল সেটা দেখানো হবে না? কিংবা সেমিফাইনালে বেলজিয়াম ম্যাচের সেই চোখধাঁধানো জোড়া গোলের ফুটেজ দেখাচ্ছ না? আসলে চে গুয়েভারার ভক্ত, ফিদেল কাস্ত্রোর অভিন্নহৃদয় বন্ধু বলেই মারাদোনাকে খাটো করে দেখানোর প্রয়াস। মনে রাখতে হবে, কাউকে খাটো দেখিয়ে নিজে বড় হওয়া যায় না। প্রতিভাকে ছাইচাপা দিয়ে রাখা যায় না বলেই তো তৃতীয় বিশ্বে মারাদোনার অগণিত ভক্ত। নিজের উপার্জন থেকে অর্থসাহায্য করে নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানো মারাদোনা সত্যিই অতুলনীয় হয়ে থাকবেন আমাদের কাছে। ২৫ নভেম্বর ২০১৬ কাস্ত্রোর মৃত্যুদিন। এবার সেদিনই চলে গেলেন ফুটবল ঈশ্বরও।