ফায়েজ আর তাঁর কবিতার মতো একই দশা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আর তাঁর বন্দেমাতরমের। ইতিহাস যে কত অজানা তথ্য এ বিষয়ে দেয় তা পৃষ্ঠা না ওল্টালে বোঝা যাবে না। স্বাধীনতার বহু আগে থেকেই এই বন্দেমাতরমকে ইসলাম-এর তৌহিদ বিরোধী বলে ধরা হতো। যদিও বন্দেমাতরম এর জনপ্রিয়তা ব্রিটিশ বিরোধী, ঔপনিবেশিকতা বাদ বিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্রে এক বিশেষ স্থান নিয়েছিলো--- "we have evidence that it was sung in the calcutta sessions of Indian national congress in 1896-- the song was rendered by Rabindranath Tagore and the music was composed by him" (Vande Mataram, Biography of a Song, Sabysachi Bhattacharya, page 19)! স্বদেশী আন্দোলনকারীরা ১৯০৫ এর বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময়তেও গেয়েছিলেন "বন্দেমাতরম। এমন কি গান্ধীজি বলেন, প্রথমবার শুনেই তাঁর অন্তর বিগলিত হয়( "Gandhi says his heart was touched when he first heard it, when he was just a lad"---M K Gandhi in Harijan 1 st july 1939)! কিন্তু সে সময়তে এই গান নিয়ে বিতর্কও দেখা যায় যে এই গানটি জাতীয় সঙ্গীত হতে পারে কিনা। বিশেষত মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে এটি পৌত্তলিকতা সমর্থনের সমার্থক হয়ে দাঁড়ায়। বাংলা জার্নাল ইসলাম দর্শন ১৯২০ তে লেখে "The only and Supreme Allah's kalima Allahu Akbar when combined with Hindus anthem to mother India, Vande mataram was found objectionable -- it was pushing the Muslims to idolatry".(Haram and Kafur, Abdul wadud, Islam Darshan Vol 1). একই ধরনের বক্তব্য উঠে এসেছিল ১৯২৮ এর শরিয়ত - এ- ইসলাম পত্রিকায় --"We must remind you of Shariat and that chanting Vandemataram is forbidden for Muslims"(Editorial on Vandemataram, Shariat- e- Islam, vol3 No 11 1335 BS. M. N. Islam,op,cit, p 245).
১৯৩৭ সালে কংগ্রেসের কলকাতায় অনুষ্ঠিতব্য ওয়ার্কিং কমিটি মিটিং-এর আগে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস রবীন্দ্রনাথকে লেখেন," while I writing to you, I also plan to write to Jawaharlalji.... Discussions are going on in Congress circles on the subject of Vande matram. On 26 October (1937) Congress working committee at their meeting in Calcutta will address the issue. Perhaps the committee will decide to discard the song. I do not know your opinion on this matter and that is why I write to you. In Bengal and among Hindus outside of Bengal great excitement has been caused and I write to you now because many friends advised me to do so". (Subhas Bose, letter to Rabindranath Tagore, 16 October 1937)
রবীন্দ্রনাথ এর উত্তরে কি বললেন? যেটা বললেন সেটা দেখে বোঝা যায় রবীন্দ্রনাথ কতখানি দূরদর্শী ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষতা ও বহুত্ববাদ রক্ষার ব্যাপারে---"To me the spirit of tenderness and devotion expressed in it’s first portion, the emphasis it gave to beautiful and beneficent aspects of our motherland made a special appeal, so much so that I found no difficulty in dissociating it from the rest of the poem and those portion of the book of which it is a part, with all the sentiments of which, brought up as I was in the monotheistic ideals of my father, I could have no sympathy "(Rabindranath Tagore letter to J Nehru, President of Indian National Congress,, 26 0ctober 1937/ Rabindra Jeebanee, Prabhat Kumar Mukhopadhyay, Vol IV). রবীন্দ্রনাথ বন্দেমাতরম এর ভিতরের ছত্রগুলি বাতিল করার স্বপক্ষে টেনে নিয়ে এলেন তাঁর পিতার একেশ্বরবাদের প্রতি আসক্তির কথাগুলিও।
শেষ মেষ ১৯৩৭ সালের কংগ্রেসের কলকাতার ওয়ার্কিং কমিটি ঠিক করে যে বন্দেমাতরম এর প্রথম দুই স্টাঞ্জাই জনসমাবেশে গাওয়া হবে, যার মধ্যে বিরক্তিকর কোনও অংশ নেই। এমন কি এই গান না গাওয়ার ক্ষেত্রে ছুট দেওয়া হয়, এমন কি অন্য কোন আপত্তিকর গান না গাওয়ার (বন্দেমাতরম এর পরিবর্তে) স্বাধীনতা দেওয়া হয়। প্রাবন্ধিক এ জি নুরানি, ফ্রন্টলাইন ম্যাগাজিনের ১৯৯৯ সালের জানুয়ারির প্রথম সংস্করনে লেখেন--" Taking all things into consideration, therefore the committee recommended, that wherever Vande mataram is sung at National gatherings, only the first two stanzas should be sung,with perfect freedom to organisers to sing any other song of an unobjectionable character in addition to or in the place of Vande mataram song".( Quoted from the article, why Muslims reject Vande Mataram, written by A. Faizur Rehman in HT Image, Aug 30 2006).
কংগ্রেসের এতো ছাড়ও কোনও কাজে এলো না। জিন্না ১৯৩৮ -এর মার্চে একটি চিঠিতে নেহেরুকে বললেন, "Pandit Jawaharlal Nehru cannot be unaware that Muslims all over have refused to accept the Vande mataram or any expunged edition of the anti Muslim song as a binding national anthem"(M A Jinnah, letter to J Nehru 17, March 1938, P.P Documents, page 361). বন্দেমাতরম নিয়ে যে উত্তেজনার পরিবেশ তৈরি হচ্ছিল, তার প্রশমনের জন্য, ১৯৩৯ এর জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত ওয়ার্কিং কমিটি মিটিং ওয়ার্ধাতে গান্ধী লেখেন, ".......in the present state of things, in local board and Assembly meetings which their members (are) obliged to attend the singing of Vande mataram should be discontinued." (Vande Mataram, the Biography of a song, page 40)
দেশ স্বাধীন হয়েছে। গান্ধীজি খুন হয়েছেন। কিন্তু বন্দেমাতরম নিয়ে বিতর্ক এখনও শেষ হয়নি। স্বাধীনোত্তর কালেও যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একটি অংশের মধ্যে যে ক্ষোভ এখনও বিরাজমান, সেই বিষয়ে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পোর্টালে ১৭ জুলাই ২০১৭ সংখ্যায় "A history of the origin of the Vande mataram and It's journey thereafter" নিবন্ধে রাধিকা আয়েঙ্গার লিখছেন, --- "In 2006 General Secretary of Jamiat ulema Hind (important Islamic organisation in India) Maulana Mahmud Madani said, "No Muslim can sing Vande mataram, if he consider himself to be a true believer" তারপরে আরও জানালেন, "Then in 2009 Muslim clerics issued fatwa against the singing of Vande mataram in Deoband!" স্বাধীন ভারতে বন্দেমাতরম কতখানিক ক্ষোভ এক শ্রেনীর নাগরিক এর মাঝে তৈরি করেছে তা ২৭ শে জুলাই ২০১৭ এর মৃত্যুঞ্জয় বোসের লেখা ইংরেজি দৈনিক ডেকান হেরাল্ড এর "Shot me, but still won't sing Vande mataram, says Muslim leader" নিবন্ধে দেখা যায়। তিনি লিখছেন, "The issue of singing Vande mataram sparked off a big political contriversy in Maharashtra with two legislators -- Abu Asim Azim of Samajwadi party and Waris Pathan of Owasi brothers led All India Majlis e Ittehedul Muslimeen saying that it can not be forced on other to prove the sense of nationalism".
সাহিত্যের জন্ম হয় সময়ের গর্ভ থেকে। তা সে পাস্তারনেকের ডঃজিভাগো হোক, বা ফায়েজের" আজ বাজার মে পা বা যাওলা চলো" অথবা বংকিমচন্দ্রের আনন্দমঠ থেকে উঠে আসা বন্দেমাতরম। সময়ের প্রেক্ষাপটে বিচার না করলে সৃষ্টির প্রতি অন্যায় করা হয়। ঐতিহাসিক তনিকা সরকার তাঁর গ্রন্থ "Birth of Goddess, Vande mataram, Ananda math and Hindu nationhood."-এ এই সময়ের উল্লেখ করেছেন যখন পুতুল নবাবদের পিছন থেকে চালাচ্ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোং। কোম্পানি রাজস্ব আদায় করতে গিয়ে দরিদ্র প্রজাদের রক্ত চোষা শুরু করেছিল। যে কোনও ভাবে রাজস্ব বৃদ্ধিই ছিল তাঁদের লক্ষ্য। অত্যাচার এতটাই ভয়ংকর ছিল যে তার সাথে আসা ক্রমান্বয়িক খরা চরম দুর্ভিক্ষের জন্ম দেয়। বাংলার এক তৃতীয়াংশ মানুষ মারা যান। তিনি আর ও বলেন, আনন্দমঠ উপন্যাসে দেখানো হয়েছে, কিভাবে এই দুর্যোগ দরিদ্র সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু কৃষক আর মুসলিম নবাবদের সংঘাতে পরিনত হয়--"The Nawabs responsible not just for wide spread death and starvation, but also for a deliberate total destruction of Hindus, of their honour, faith, caste and women. In other words it forces a split between the agents and victim of the famine, the agents are Muslims and the striving and dying people are already identified as Hindus". (collected from the article "A history of the origins of Vandemataram and It's journey thereafter" written by Radhika Iyenger July 27, 2017 in the Indian Express portal)।
বন্দেমাতরম এ যে পৌত্তলিকতার কথা বলা হয়, বঙ্কিমচন্দ্র কি আদতে পৌত্তলিকতার পক্ষে ছিলেন? ১৮৭৪ এ তিনি মূর্তি উপাসনা বিষয়ে একটি নিবন্ধ লেখেন----"If an object which I see is made of stone or earth attracts our devotion, why can one give the same devotion to a being unseen but all- pervading in the universe?.. Idolatry is anti science. Whenever idolatry prevails, knowledge does not advance" [Bankim Chandra, বঙ্গে দেব পূজা (Deity worship in Bengal), 1281 BS or AD 1874, In বঙ্কিম রচনাবলী, কলকাতা, সাহিত্য সংসদ, ১৯৫৬, ভলুউম ২, পৃষ্ঠা ৮৯৩-৮৯৬] আবার সব্যসাচী ভট্টাচার্য্য তার বন্দেমাতরম, দ্য বায়োগ্রাফি অফ আ সঙ্গ গ্রন্থে ৮৩ পাতায় বলেছেন, ---"while most readers naturally look upon it as the poetic representation of the country, it has also been represented as a Comtist hymn, an anti theocratic ode of nationalism free from the cult of Gods, an outcome of chatterji's patriotic doctrine of the country as the object of worship... Integrally associated with his Comtist religion ".
বঙ্কিমচন্দ্র এর উপর ফরাসী দার্শনিক অগস্ত ক্যঁতের প্রভাব ছিলো যথেষ্ট। অগস্ত ক্যঁতে পজিটিভিজম তত্ত্বের জনক। উইকিপিডিয়া বলছে, পজিটিভিজম হলো--" Positivism is an empirical philosophical theory that holds that all genuine knowledge is either true by definition or a positive---- meaning a posteriori facts derived by reason and logic from sensory experience. Other ways of knowing, such as theology, metaphysics, intuition or introspection are rejected or considered meaningless" সব্যসাচী ভট্টাচার্য্য তার উপোরক্ত গ্রন্থে (৮৫ পৃষ্ঠাতে) বলেছেন, " Auguste Comte had said that for a system to rise and generally accepted it must be...in agreement with our nature and far from unfavourable to our progress. Bankim quoted this and argued that religion and It's reform must be in agreement with the nature and culture of the people. It is almost certain that this conviction influenced the discursive tone of Anandamath and the admixture of a patriotic message with religious symbolism in the expanded version of Vandemataram in 1881-82".
বন্দেমাতরম কতখানি সাম্প্রদায়িক বা পৌত্তলিকতার পক্ষে এটা বিতর্কের বিষয়। তবে কাউকে জোর করে কোনও সামাজিক বা রাজনৈতিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ করা যায় না। ঠিক ও নয়। তা সে ফায়েজের বামপন্থাই হোক বা বঙ্কিমচন্দ্রের জাতীয়তাবাদই হোক। তবে এত বিতর্ক, আপত্তি, ক্ষোভের পরও পাস্তারনেক, ফায়েজ, বঙ্কিমচন্দ্ররা বেঁচে থাকবেন। পাস্তারনেক নোবেল পাবেন, ফায়েজ লেনিন অর্ডার ফর পিস পাবেন। আর বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে ২৫০০০ শ্রোতা ভোট দিয়ে বলে দেবেন বন্দেমাতরম ভারতের দুটো জনপ্রিয় সঙ্গীতের মধ্যে একটি (Indian Express 22 December 2002)! মহামান্য মাদ্রাজ হাইকোর্ট ২০১৭ এর জুলাই মাসে রুলিং জারি করেন এই মর্মে যে তামিলনাড়ুর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলিতে সপ্তাহে একদিন অন্তত বন্দেমাতরম গাইতে বলবেন। বন্দেমাতরম-- দেশ মাতাকে প্রনাম।
।। সমাপ্ত ।।
সুকোমল কান্তি দাশ
(লেখক একজন সরকারি আধিকারিক। পড়াশুনা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে-- যথাক্রমে ইতিহাস, সাংবাদিকতা ও আইন নিয়ে।)
আরও পড়ুনঃ আহত বাক্যবন্ধরা - (প্রথম পর্ব)