......এবার আমরা ডেকে নিচ্ছি আমাদের গর্ব, আমাদের গ্রামের রত্ন শ্রীতমা দত্তকে। ওনাকে সম্বর্ধনা জানাবেন আমাদের এলাকার বিশিষ্ট সমাজসেবী শ্রী প্রতাপ চৌধুরী।
একটি ছিপছিপে শ্যামলা মেয়ে উঠে এল মঞ্চে। মেয়ের চোখে অসম্ভব একটা আত্মবিশ্বাস। মুখে একটা আত্মপ্রসাদের হাসি।
ভাবছেন তো কে এই শ্রীতমা? কেন তাকে সম্বর্ধনা দেওয়া হচ্ছে?
শ্রীতমা এই পূর্ব বর্ধমান জেলার একটি ছোট গ্রাম কানপুর এর মেয়ে। আজ সে জাতীয় ক্রিকেট দলের সদস্য রূপে খেলার সুযোগ পেয়েছে। তাই গ্রামের ক্লাব থেকে ওকে সম্বর্ধনা দেওয়া হচ্ছে।
ওকে ওর এই সাফল্যের কথা বলতে বলা হলেও একটু হাসল যেন নিজের মনে। হাসবে নাই বা কেন! কারন এখন ও যদি ওর আজকের সাফল্যের কথা বলতে গিয়ে ওর জীবন সংগ্রামের কথা সব বলে তাহলে উপস্থিত অনেকেই অস্বস্তিতে পরবে। তাই যতটুকু বলা যায় সেটুকুই বলে।
কারন শ্রীতমার চলার পথ মোটেও সহজ হয়নি। খুব ছোট বেলায় বাবাকে হারায়। না বাবা মারা যায়নি, হারিয়ে গেছে । তাঁর স্মৃতি হারিয়ে গেছিল। কোনো একদিন অজান্তেই বেরিয়ে পড়েছিলেন বাড়ি থেকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। আর তখন থেকেই ওদের মা মেয়ের জীবন যুদ্ধ শুরু। মা মিনতি দেবী সাধারণ গৃহবধূ। লেখা পড়ার খুব বেশি জানতেন না। তাই জীবন টা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
কিন্তু গ্রাম হলেও বেশ বর্ধিষ্ণু। অনেক মানুষ বাস করে সে গ্রামে। চার পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে বিডিও অফিস, ব্যাঙ্ক, কলেজ থাকায় সেখানে বহু মানুষের বাস। সেখানে ই অনেক চেষ্টার পর দু-তিন ঘরে রান্নার কাজ পেয়ে যায়। আর তাতেই মা মেয়ের দিন চলে যায়। শ্রী গ্রামের স্কুলে পড়াশোনা করে। তার সাথে বাড়িতে ও ঘরের কাজ করতে হয়। মা সকালে উঠে কাজে চলে যায়। তাই ঘরের যাবতীয় কাজ ওকে করে আগের দিন করে রাখা ভাত খেয়ে স্কুলে যেতে হয় ওকে। এই ভাবে চলতে থাকে মা মেয়ের জীবন।
একদিন সে মায়ের সথে মা যেখানে রান্না করে তাদের বাড়িতে যায়। সেই বাড়ির ছেলেটি বাড়ির পাশের মাঠে ক্রিকেট খেলতে যায়। শ্রী তখন ক্লাস সিক্স। ও ছোটো থেকেই খেলাধুলায় খুব ভালো। স্কুলে ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় বরাবরই পুরস্কার পায়। ও ক্রিকেট খেলা খুওব ভালোবাসে। ইন্ডিয়া টিমের খেলা থাকলে ও দেখবেই পাড়ায় কারও বাড়িতে। কারন টিভি কেনার মত সামর্থ তাঁদের নেই, এই ব্যাপারে অনেকে ওর মাকে নানা কথা শোনায়। ও যখন ছেলেদের সঙ্গে খেলতে যায় গ্রামের লোকেরা নানারকম কথা বলে। কিন্তু শ্রী খেলা ছেড়ে যেন থাকতে পারে না। এরপর ও মেয়েদের ক্রিকেট দলের কথা শোনার পর স্বপ্ন দেখতে থাকে। কিন্তু জানে যে সে স্বপ্ন পূরণ হবার নয়। তবুও স্বপ্ন আসে নিজের মত করে। মায়ের সঙ্গে গিয়ে ক্রিকেট কোচিং সেন্টার দেখে ওর ইচ্ছাটা প্রবল হয়। তারপর থেকে ছুটির দিনে সে মায়ের সাথে মাঠে যায়। মা রান্না করে আর ও মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে দেখে কি করে খেলা হয়।
শ্রীতমাকে সপ্তাহে ওই বিশেষ দিনে মাঠের পাশের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একদিন কোচিং সেন্টারের কোচ ওকে জিজ্ঞাসা করেন ওর বাড়ি কোথায়? ও এখানে কার সাথে আসে? ও তখন সাহস করে বলে "ও দাদা আমাকে ক্রিকেট শেখাবে?"
শুনে অবাক হয়ে যায় কোচ অনির্বাণ রায়। বলে এখানে তো মেয়েদের শেখানো হয়না। তুমি একা কি করে শিখবে?
ও বলে কি হয়েছে আমি একাই শিখবো। দেখবে আমাকে দেখে অনেক মেয়ে আসবে।
কথাটা বেশ ভালো লাগে অনির্বাণের। ও বলে "বেশ আমি ক্লাবের সাথে কথা বলি"।
পরের সপ্তাহে শ্রী ঠিক হাজির হয়। সেদিন দেখে আরও কয়েকজন রয়েছে। ওকে বলেন, তুই খেলার কথা বলেছিস?
হ্যাঁ!
একজন বলে ওঠেন জানিস এই খেলার খরচ?
ছোটো শ্রী খেলার খরচের কথা শুনে একটু অবাক হয়। ছোটো মনে সেটা ঢোকে না, শুধু অবাক চোখে তাকায়।
যারা এসেছেন তাদের মধ্যে একজন বলেন ঠিক আছে ও যদি খেলতে চায় খেলুক। আমরা ক্লাবের তরফ থেকে যত টা পারব সাহায্য করবে।
সেই শুরু শ্রীতমার আরেক যুদ্ধ। ওর মা অবশ্য প্রথম প্রথম রাজী ছিলেন না। কিন্তু মেয়ের ইচ্ছা আর অদম্য জেদের কাছে হেরে যান শেষ পর্যন্ত। মেয়েকে আরও একটু ভালো খাবার দেওয়ার জন্য আরও এক বাড়ি কাজ নেন মিনতি। মেয়ের খেলা নিয়ে গ্রামের অনেকে বলে,
'মেয়ে মানুষের আবার ওত লাফালাফি কিসের ছেলেদের সাথে?'
আবার অনেকে বলে 'কুঁজোর ও সখ হয় চিৎ হয়ে শুতে'
এসব কথা যত শুনে শ্রীতমার মনে জেদ আরও বেড়ে যায়। একদিন অনি'দা ওকে বলে 'তোর স্বপ্ন পূরণ করতে হলে আরও বড়ো জায়গায় শিখতে হবে।'
...আমি কি করে বড়ো জায়গায় শিখবো অনি দা?
দেখি একবার সুধীরদাকে বলে। সবার বিরুদ্ধে গিয়ে উনিই তো তোর খেলার ব্যবস্থা করেছিলেন। আজ পর্যন্ত তোর যাবতীয় সরঞ্জাম উনিই কিনে দিয়েছেন। উনি যদি আরও একটু সাহায্য করেন তাহলে তোকে দূর্গাপুরের একটা ক্লাবে ভর্তি করে দিতে পারব, আমার চেনা আছে।
সুধীরদা সাহায্য করে, শ্রী ভর্তি হয় দূর্গাপুরের ক্লাবে। ওর মাকে ও ওখানে কাজের ব্যবস্থাও করে দেয় ওরা। তবে এসব কিছু সহজ হয়নি। গ্রামের অনেকে অনেক বাজে কথা বলেছে ওর মাকে। যারা আজ ওকে নিয়ে এত উচ্ছাস দেখাচ্ছে তারাই যে একদিন নোংরা কথা বলতেও ছাড়েনি মা'মেয়েকে।
নিজের জেদে অটুট শ্রী মাকে শুধু বলেছে দেখবে একদিন সবাই আমাদের কাছে হেরে যাবে।
এরপর শুরু হয় আরেক লড়াই। শহরের বড়ো ঘরের মেয়েদের সাথে খেলা সহজ নয়। সহজে কেউ মেনে নিতে পারে না গ্রামের গরীবের মেয়ে শ্রীতমাকে। পদে পদে হেনস্থা করতে থাকে। ঠিক যেমন কোনি গল্পে আমরা দেখতে পাই। ওর পোষাক নিয়ে হাসাহাসি করে ওখানকার মেয়েরা। এসব কিছু মাঝে মাঝে শ্রী'কে একটু দুর্বল করে দেয়। কিন্তু সবাই তো সমান হয় না; শর্মিলা শ্রীতমার বন্ধু হয়ে ওঠে। শহরের মেয়ে হলেও ও একটু অন্য রকম। ও বোঝে শ্রীতমার কষ্ট। শ্রী যখন ভেঙে পরে ও বোঝায় কোনো কিছু খেলার থেকে বড়ো নয়। শর্মিলা বোঝে শ্রী এর মধ্যে একটা আগুন আছে যে টা ওকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে।
এর মধ্যে আসে বাংলা দলের টিম নির্বাচনের সময়। ক্লাবের হয়ে ও খুব ভালো খেলে তবু অনেক চেষ্টা চলে শ্রী কে না নেওয়ার। কিন্তু ভগবান যার সহায়তা হন তাকে কেউ হারাতে পারে না।তাই কোন কিছু পারে না ওকে থামাতে। ও বাংলা দলে নির্বাচিত হয়। খেলে খুব ভালো। এবার যেতে হয় কোলকাতায়। সেখানেও ওকে সাহায্য করে সুধীর দা। মা মেয়ের থাকার আর মায়ের কাজের ব্যবস্থা করে দেয়। ওখানেও রান্নার কাজে লাগিয়ে দেয়। এখানে ক্লাব আরও বড়ো আরও ভালো ব্যবস্থা। শ্রী তো খুশিতে নেচে ওঠে। কিন্তু প্র্যাকটিস করতে গিয়ে বোঝে আরও কঠিন জায়গায় এসে পৌঁছেছে সে।
কিন্তু স্বপ্নটা তো মনের মধ্যে গেঁথে গেছে জোরদার ভাবে। তবে ওখানে বাংলার দুই মহিলা ক্রিকেটারের চোখে পড়ে শ্রী। ওর একাগ্রতা ও অধ্যবসায় তাদের মুগ্ধ করে। তারা ওকে যথাসম্ভব সাহায্য করেন।
এইসময় বাংলা টিমে সূযোগ না পেয়ে পূর্ব ভারতের অন্য একটি রাজ্যের হয়ে শ্রী খেলে।
এখন কোনো বাধা আর যেন অন্তরায় না হয় শ্রীতমার জীবনের পথে এই প্রার্থনা করে ওর মা। কিন্তু সেটা তো সহজ নয়। তবে ওর অধ্যবসায় দেখে সুধীর দার মত সহৃদয় ব্যক্তি এখানেও এগিয়ে আসেন ওকে সাহায্য করতে। আর এই মানুষগুলো আছেন বলেই এখনও পৃথিবীর বুকে শ্রীতমার মত মেয়েরা সফলতা পায়।
হাজার রকম বাধা সত্ত্বেও শ্রীতমার প্র্যাকটিস চলতে থাকে। এরপর আসে সেই দিন জাতীয় স্তরে নির্বাচনের দিন। প্রথমে তো ওকে জানানোই হয়না। কিন্তু ভাগ্য সঙ্গে থাকলে সব হয়, ও জানতে পারে নির্বাচনের কথা। ক্লাবের সেক্রেটারির কাছে যায়।
স্যার আমি কি যাব না জাতীয় স্তরের নির্বাচনে? বলে শ্রী
তুমি! তুমি কি করে যাবে? তুমি এই সবে কয়েক মাস হলো এসেছো।
তাও... আমাকে একটা সূযোগ দিন!
না না ওইভাবে হয় না। তুমি এখন যাও। বলে ওকে সেখান থেকে চলে যেতে বলে।
ও বেরিয়ে যাওয়ার সময় আর একটি মেয়ে ঢোকে। তাকে ঢুকতে দেখে দাঁড়িয়ে পরে শ্রী। তারপর ওদের কথোপকথন শুনে বুঝতে পারে এখানেও খেলা চলছে। ওর পরে যে মেয়েটি ক্লাবে আসে সে কোনো বড়ো ব্যক্তির আত্মীয় তাই সে যাবার সূযোগ পেয়ে যায়।
এসব শুনে মন ভেঙে যায় শ্রীতমার। এমন সময় শর্মিলা ওকে বলে তুই চিন্তা করিস না আমি ব্যাপারটা দেখছি। শর্মিলা মেয়েটি খুব চটপটে। ও সব জানায় যতীন্দ্রমোহন বসুকে যে এই ক্লাবের সব বিষয়ে নিজের মতামত জোরদার ভাবে চাপাতে পারেন। ভদ্রলোক খুব অমায়িক। উনিই সেই ব্যক্তি যিনি শ্রী কে এখানে সবরকম ভাবে সাহায্য করেন। উনি আসলে খেলা টা ভালোবাসেন এবং বোঝেন। আরও বোঝেন কার দ্বারা কি হবে।
তাই প্রথম দিন থেকেই উনি শ্রীতমার খেলা র অনুরাগী হয়ে ওঠেন। ওকে সবরকম সাহায্য করতে থাকেন।
উনি শর্মিলার বাবার বিশেষ পরিচিত।শর্মিলা ওনাকে সব বলে। উনি সব শুনে চুপ করে যান। শুধু বলেন ঠিক আছে আমি দেখছি।
ক্লাবের কমিটি যে দিন নাম নির্বাচন করবে সেদিন উনি বললেন সবার আগে শ্রীতমার নাম লেখা হোক। আজ পর্যন্ত ওর মতো কেউ খেলেনি এই ক্লাবে।
দু একজন আপত্তি জানানোর চেষ্টা করেন কিন্তু ওনার ব্যক্তিত্বের কাছে চুপ করে যেতে বাধ্য হন। শেষ পর্যন্ত শ্রীতমার নাম পাঠানো হয়। এরপর শ্রীতমা কঠিন পরিশ্রম করতে থাকে। স্বপ্ন যেন দুয়ারে এসে কড়া নাড়ছে। যত দিন এগিয়ে আসে শ্রীতমার জেদ ও বাড়তে থাকে। নিজের সাথে যেন নিজের কথা আমাকে পারতেই... হবে। আসে সেই দিন, ট্রায়াল ম্যাচ হবে। চারটি ভাগে খেলা হয়, টিম এ, বি, সি, ডি। দুটি ম্যাচে খুব ভালো বোলিং করে এবং একটিতে রানও করে ভালো। অলরাউন্ডার হিসেবে ওর পারফরম্যান্স বেশ ভালো হয়। তাছারা গ্রামের এবড়ো খেবড়ো মাঠে খেলার সুবাদে ফিল্ডিং-এ বরাবরই খুব ভালো ছিলো শ্রী। সেটাই তফাত গড়ে দিলো বাকিদের সাথে। শ্রী নিজের সবটুকু উজার করে খেলে। এত ভালো পারফরম্যান্স হবে ও ভাবতেও পারেনি। ও সিলেক্ট হয় ইন্ডিয়া-এ আন্ডার নাইনটিন এ টিমে।
খবরটা সংবাদ মাধ্যমে বের হতেই গ্রামে হইচই পরে যায়। একসময় যারা বিরোধীতা করে ছিল তারা আজ শত মুখে প্রশংসা করতে থাকে।
শ্রীতমা স্পোর্টস কোটায় চাকরি ও পেয়ে যায়।
আজ গ্রামের মাঝে মাথা উঁচু করে মা মেয়েকে হেঁটে যেতে দেখে তারা ই আজ বাহবা দিচ্ছে যারা একদিন ওদের অপমান করতে ছাড়েনি।
আজ শ্রীতমার স্বপ্ন আর তা পূরনের ইচ্ছার কাছে সব হেরে গেছে।
শ্রীতমার সফলতা আমাদের গ্রামবাংলায় অনেক শ্রীতমার জন্ম দেবে।
লেখিকাঃ রাখি রায়
রাখি রায়-র কলমে আরও কিছু লেখা
আরও পড়ুনঃ বিষাক্ত গোলাপ - (ছোট গল্প)
আরও পড়ুনঃ রক্তের টান - প্রথম পর্ব
আরও পড়ুনঃ রূপু আমাকে ক্ষমা করিস
আরও পড়ুনঃ উত্তরণ (বাংলা ছোট গল্প)
আরও পড়ুনঃ নতুন প্রভাত
আরও পড়ুনঃ মিঠির ডায়েরি (বাংলা ছোট গল্প)
আরও পড়ুনঃ রাজবাড়ির রহস্য (ধারাবাহিক গল্প)- প্রথম পর্ব
আরও পড়ুনঃ রাজবাড়ির রহস্য (ধারাবাহিক গল্প)- দ্বিতীয় পর্ব
আরও পড়ুনঃ রাজবাড়ির রহস্য (ধারাবাহিক গল্প)- তৃতীয় পর্ব
আরও পড়ুনঃ রাজবাড়ির রহস্য (ধারাবাহিক গল্প)- চতুর্থ পর্ব
আরও পড়ুনঃ রাজবাড়ির রহস্য (ধারাবাহিক গল্প)-অন্তিম পর্ব
- More Stories On :
- Cricket
- Small Story
- Inspirational
- Purba Bardhaman