ভীষণ তিতকুটে স্বাদ ঢুকে যাচ্ছে মুখের ভেতর... চোখের ফাঁকে সাবানজলের তীব্র জ্বালা... চোখ আরো টিপে বন্ধ করতে গিয়ে দরবিগলিত অশ্রুধারা... ঝরছে... মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে নাকের জলে-চোখের জলে-মগের জলে... সর্বাঙ্গে ধুঁধুলের ছোবড়ার কর্কশ দৌড়দৌড়ি...চলছে প্রবল দলাইমলাই... আমার পরিত্রাহি চিৎকারে একটু দুরের ছাত্রাবাস থেকে ছুটে আসছে বাবার ছাত্ররা কেউ কেউ... কোয়ার্টারের কলতলায় বিপর্যস্ত আমাকে কেউ যোগাচ্ছে সাহস, কেউ দিচ্ছে সান্ত্বনা...আমার ছোটবেলায় সবচেয়ে ভয়াবহ দুটি কর্তব্যকর্মের মধ্যে একটি ছিল এই সাবানজলে স্নান করা, রবিবারের সকালগুলো আজো যার জন্য দাঁতখিঁচোনো স্মৃতি হয়ে আছে; আর সেই নিদারুন নির্যাতনের প্রধান কুশীলব ছিল একটি সাবান , যার নাম মার্গো I নিমের তেল ও নির্যাস দিয়ে তৈরী এই সাবান নামক আতঙ্কটি বানিয়ে ক্যালকাটা কেমিক্যাল কোম্পানি আমার মতো লক্ষ লক্ষ অপোগন্ড বাঙালী বালকবালিকার কোটি কোটি অভিশাপের ভাগী হয়েছেন বলে আমার বিশ্বাস। কালচে-সবুজ ইষ্টক-সম একটি খুদে অ্যাটম বোম, উগ্র কষায় স্বাদে গন্ধে যা জিনা হারাম করে ছেড়ে দিত... তার প্রতি আমাদের বিরাগ ও বাঙালী বাপ মায়েদের অনুরাগ সমানুপাতে চলাফেরা করতো। আমার সারা স্কুলজীবনে আমাদের বাড়িতে মার্গো ভিন্ন অন্য কোনো সাবান প্রবেশাধিকার পায় নি। কম দাম, বেশী উপকারিতা আর নিমের সর্বরোগহর গ্ল্যামার তো আছেই; ত্বকের স্বাস্থ্যরক্ষায়ও নাকি তার জুড়ি মেলা ভার! ব্যাস, আর কী চাই! একেবারে প্লেন লিভিং হাই থিঙ্কিং-এর চূড়ান্ত!আরও পড়ুনঃ পুজো শুরু হয়ে গেলষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময় একবার রেশন দোকান থেকে মিলেছিল একটি ফিকে সবুজ সাবান (তখন শুধু চিনি-কেরোসিন-গমই সাধারনতঃ মিলত সেখানে)I একটু নরমসরম, মিষ্টি মিষ্টি গন্ধে বিগলিত হয়ে দীর্ঘ স্নান সারলাম তার সাহচর্যে। ফলাফল হলো ভয়াবহ... ঘন্টাখানেক বাদে সর্বাঙ্গে খড়ি উঠে হাফ-সাহেব বনে গেলাম। ভুরভুরে সুবাসের আড়ালে সেই রেশন-শোভন সাবানের নিম্নমান গোটা পরিবারকে আরো ঠেলে দিল মার্গো-র মৃত্যু-মার্গে!আরও পড়ুনঃ তোমাদের মনের মতো রঙীন পূজাবার্ষিকী-- আনন্দমেলাআমার শৈশবের রবিবারগুলি তাই মার্গো-ময়! সেই হাকুচ -তিতো স্নান-বিপাককে পরিহাস করতেই বুঝি বা তিরাশি সালে আকাশবাণীর বিজ্ঞাপনে শুরু হয়েছিল মার্গো-র এই নাম-সংকীর্তন...পথেঘাটে ভিড়ভাট্টা মেজাজটা তাই খাট্টা,গাড়ি লরী ধুলোবালি ঝকমারী সব একা তালগোল;নাকেমুখে ধোঁয়ার ধাক্কা, করবো কি তার তোয়াক্কা?মাখি তাই রোজ ভাইআদি নিম খাঁটি নিম মার্গো।ফুরফুরফুর স্নানের ফুর্তি জীবাণুর হবে ছুটি,মাখি তাই রোজ ভাইআদি নিম খাঁটি নিম মার্গো।সাদামাটা চেহারাটা, তবুও যে চাই প্রতি বার গো...মার্গো!পঁচাশি-র মাঝামাঝি বন্ধু নির্মাল্য-র বাড়ি বেড়াতে গিয়ে পন্ডস ড্রিমফ্লাওয়ার সাবানের প্রেমে পড়ে গেলাম। আশৈশবের ব্র্যান্ড লয্যালটিকে দূরছাই করে দিয়ে ভিড়ে গেলাম পন্ডস ক্যাম্পে। ততদিনে মেডিক্যাল কলেজের হোস্টেলে গিয়ে কিঞ্চিত স্বাবলম্বী হয়েছি, সাবান-স্নানও বিভীষিকা থেকে স্নান-বিলাসে বদলে গেছে। এরপর ঘুরেফিরে পন্ডস-এর তিনটি ব্র্যান্ডই স্থান পেতে লাগলো সাবান-কেসেI যেমন সুন্দর মোড়ক তাদের, তেমনই খোশবাই আর মখমলী মোলায়েম স্পর্শ!আরও পড়ুনঃ বাজলো তোমার আলোর বেণুনেশা লেগে গেল একের পর এক নতুন নতুন সাবান ব্যবহার, ও তাদের সুন্দর সুন্দর মোড়ক সংগ্রহের। রঙ-রূপ-গন্ধ-স্পর্শের মেলায় ভরে উঠতে থাকলো ছোট্ট সেল্ফ। সাবানের দুনিয়ায় কি বৈচিত্র্যই না ছিল সেই আশি-নব্বইয়ের দশকে। সস্তা আকাশী ফ্রেসকা বা রেক্সোনা থেকে শুরু করে রুচিশীল মাইশোর স্যান্ডাল সোপ, মার্গো-র জ্ঞাতি-ভাই হামাম, সুগন্ধী সিন্থল, লাইফবয় থেকে অভিজাত অ্যারামাস্ক (অনেকে মজা করে বলতেন আরামসুখ) বা হালকা বেগুনী মনমাতানো সৌরভের ল্যাভেন্ডার ডিউ... গঙ্গাজল দিয়ে তৈরী গঙ্গা সাবান...আরও পড়ুনঃ শারদঅর্ঘ্য...আটের দশকের শেষদিকে আবির্ভূত পামোলিভ সাবান বা নিরমা বিউটি সোপ (নিউ এম্পায়ারে যে সাবানের বিজ্ঞাপনে সোনালী বেন্দ্রে-র লাস্য দেখতে বহু যুবক এমনিই দশ মিনিটের জন্য টিকিট কেটে ঢুকত বলে শোনা যায়!)... শীতের শুরুতে পিয়ার্স, চেসমি, সোনালী গিসারিন সাবানের হুজুগ... বলিউডের সমকালীন শীর্ষস্থানীয়া নায়িকার কৃপাধন্য ঝলমলে লাক্স... সুরভিত নরম ডাভ-এর শৌখিনতা... চন্দনগন্ধী মোতি... এ বলে আমায় দেখ ও বলে আমায়!হস্টেলে এক বন্ধুর প্রবাসী আত্মীয় বেড়াতে এসে তাকে উপহার দিয়ে গেলেন একটি ক্যামে সাবান। সেই প্রথম আমাদের সবার ড্যাবডেবিয়ে বিদেশী সাবান দেখা। মহার্ঘ্য বস্তুটির ওপর হারামী শকুনিদের চক্ষুদান এড়াতে বাক্সে তালাচাবি দিয়ে রাখত তার মালিক! ততদিনে দূরদর্শনের তুমুল জনপ্রিয় ধারাবাহিক বুনিয়াদ-এর ফাঁকে ফাঁকে নতুন এক সাবানের মনোহর শরীরী বিজ্ঞাপন হয়ে দেখা দিয়েছেন স্বপ্নসুন্দরী ডিম্পল। সাঁতারের পোশাকে জলে ঝাঁপ, ও জলকেলির শেষে মাথা তুলে চুলের ঢেউ ঈষৎ দুলিয়ে সেই মোহময়ীর ইটস মাই ক্রাউনিং গ্লোরি! শুনে সারা দেশে কত যে নাবুঝ লড়কা মর্দ হয়ে উঠলো!আরও পড়ুনঃ কন্যা রুপেন সংস্থিতাতবু আমাদের শৈশবে একটি সাবানের বিজ্ঞাপন যে ভাবে আসমুদ্রহিমাচলকে দুলিয়ে দিয়েছিল,তার তুলনা বিরল! দুহাজার সালে খান্ডালা বেড়াতে গিয়ে দূরে পাহাড়ের গায়ে এক তরলিতচন্দ্রিকাচম্পকবর্ণা জলপ্রপাত দেখিয়ে গাইড বলেছিলেন,ওই দেখুন, লিরিল সাবানের বিজ্ঞাপনের সেই বিখ্যাত ঝর্ণা। আমার চোখের সামনে সময়ের কাঁটা কয়েক দশক পিছিয়ে গিয়েছিল এক ধাক্কায়... চঞ্চলা ঝরনায় উচ্ছল স্নানের উল্লাসে উচ্ছ্বসিত মডেল কারেন লুনেল... লা-আ-আ লা লা লা লা-আ-আ ....লেখকঃ ডঃ সুজন সরকারবর্ধমান।