ওরা আমাকে একটা পুড়ে যাওয়া বাড়ির ভিডিও পাঠায়......
বুশেনওয়াল্ড-এর অয়ারলেস ক্রমাগত আবেদন ছড়িয়ে দিচ্ছে আকাশে বাতাসে-- বুশেনওয়াল্ড কয়েদী শিবির সাহায্য চাইছে ! বুশেনওয়াল্ড কয়েদী শিবির সাহায্য চাইছে! বুশেনওয়াল্ড কয়েদী শিবির... সারা শিবিরে জয়ধ্বনি উঠেছে, বহু সহস্রের মিলিত কণ্ঠে বাঁধভাঙ্গা জলস্রোতের মত জনস্রোত ছুটে বেরুচ্ছে শিবির থেকে মাঠের পানে। উচ্ছ্বসিত, উদ্বেলিত, আনন্দ কোলাহলে মুখর এক বিশাল মিছিল।---- আমরা যারা সাত-আটের দশকে এক অমল শৈশব কাটিয়েছি এই বাংলায়, তাদের অনেকেরই পড়া জার্মান সাহিত্যিক ব্রুনো আপিজ-এর নেকেড অ্যামং উল্ভস, সুধীন্দ্রনাথ রাহা-র অনুপম অনুবাদে যে কাহিনী আমাদের প্রথম দিয়েছিল নাৎসী জার্মানীর কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের বীভৎসতার মর্মন্তুদ বর্ণনা। দেব সাহিত্য কুটির-এর প্রকাশনায় বিদেশী গল্প চয়ন বইটির বারোটি বিখ্যাত বিদেশী আখ্যানের প্রতিটিই ছিল বিশিষ্ট; তবে নেকেড অ্যামং উল্ভস বিষয়বস্তুর কারণেই ছিল তার মধ্যে নিজ বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। সেই বুশেনওয়াল্ড! ওয়াইমার-এর অনতিদূরে যে বন্দীনিবাস আউশভিৎজ-এর মতো ততো কুখ্যাতি অর্জন করে নি শুধু এই কারণে যে সেখানে গ্যাসচেম্বার ছিল না গণহত্যার জন্য। তাবলে অন্য কোনো দিক দিয়ে বুশেনওয়াল্ড-এর বন্দীশিবির কম নারকীয় ছিল না আউশভিৎজ-এর তুলনায়। স্বয়ং ব্রুনো আপিজ নাৎসী-নীতির বিরোধী হওয়ার কারণে দীর্ঘ কয়েক বছর নরকযন্ত্রণা সহ্য করেছিলেন এখানে, ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত--- মার্কিন সেনার আগমনে যখন বুশেনওয়াল্ড-এর পতন ঘটে। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি রচেছিলেন কালজয়ী এই উপন্যাস।সাতাত্তর বছর আগে অ্যাডল্ফ হিটলার-এর সেই মৃত্যুশিবির থেকে বেঁচে ফিরেছিলেন আরো এক তরুণ, উনিশ বছরের বরিস রোমানশেঙ্কো। চারের দশকের শুরুর দিকে ইহুদী বরিস রোমানশেঙ্কো বন্দী ছিলেন পর পর তিনটি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে--- পিয়েনেমুন্ডে, মিত্তেলবাউ-দোরা, এবং বার্গেন-বেলসেন। সবশেষে বুশেনওয়াল্ড-এর কুখ্যাত বন্দীশিবিরে অবর্ণনীয় কষ্টে দিন কাটছিল তাঁর, ১১ই এপ্রিল ৪৫ -এ মিত্রপক্ষের মার্কিন সেনারা সেখানকার একুশ হাজার বন্দীকে মুক্ত না করা পর্যন্ত। ২০১৮-য় ঐ ক্যাম্পের মুক্তির ৭৩-তম বর্ষপূর্তিতে শেষ জীবিত বন্দীদের অন্যতম হিসেবে উজ্জ্বল উপস্থিতি ছিল বরিস রোমানশেঙ্কো-র।নাৎসী নেকড়ে-দের উদ্যত নখ-দাঁত-থাবা থেকে রক্তাক্ত ছিন্নভিন্ন হয়েও ফিরে আসা ৯৬ বছরের বরিস থাকতেন ইউক্রেন-এর খারকিভ শহরে। নাতনি ইউলিয়া থাকেন অন্য শহরে। তিনি জানিয়েছেন: ১৮ই মার্চ সোশ্যাল মিডিয়ায় জানতে পারি, খারকিভ-এর সলতিভকা-য় শেলিং করেছে রুশ সেনা। আমি স্থানীয়দের জিজ্ঞেস করে পাঠাই, আমার দাদুর কোনো খবর জানো? ওরা আমাকে একটা পুড়ে যাওয়া বাড়ির ভিডিও পাঠায়। ততক্ষণে খারকিভ-এ কারফিউ জারী হয়েছে। ফলে তখন আর ওখানে গিয়ে উঠতে পারি নি। নাতনি যখন সেই পাড়ায় পৌঁছোতে পারলেন, দেখলেন দাদুর বাড়িটা আর নেই: পুরোটাই পুড়ে খাক। দরজা-জানালা-ব্যালকনি--- কিছুই অবশিষ্ট নেই। আর দাদু? কামানের গোলার আগুন নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে হিটলার-এর গণনিধনযজ্ঞ থেকে বেঁচে ফিরে আসা ছিয়ানব্বই বছর বয়সী মানুষটিকে।বুশেনওয়াল্ড কনসেনট্রেশন ক্যাম্প মেমোরিয়াল ইনস্টিটিউট-ও একাধিক টুইট-এ জানিয়েছে বরিষ্ঠ এই হলোকস্ট-সারভাইভার -এর চলে যাওয়ার দুঃসংবাদ। সাতাত্তর বছর আগে যে মুক্তিফৌজ নতুন জীবন দিয়েছিল বরিস-কে, সেই মিত্রপক্ষেরই প্রধান শরিক সোভিয়েত রাশিয়ার উত্তরসূরী বাহিনী এক ফুঁয়ে নিভিয়ে দিল নবতিপর মানুষটির প্রাণপ্রদীপ।নিয়তির কী নিষ্ঠুর পরিহাস!......ডঃ সুজন সরকার, বর্ধমান।(তথ্যসূত্র: এই সময়, ২৩শে মার্চ ২২)