অপরাজেয় (ছোট গল্প)
আজ অনিন্দ্য আর অপরাজেয় দুজনের জীবনের এক বিশেষ দিন। সারা ভারতের নতুন শিল্পীদের যে প্রতিযোগিতা হচ্ছে আজ ছিল তার ফাইনাল। সেখানে টুবাই অর্থাৎ অপরাজেয় প্রথম হয়েছে। অনিন্দ্য সিঙ্গেল ফাদার হিসাবে আজ সফল। কে বলে বাবারা কিছু পারেনা; মা না থাকলে সন্তান সঠিক ভাবে মানুষ হয়না!! আজ সেই সব কথা কে ভুল প্রমাণিত করে দিয়েছে অনিন্দ্য। এতে অবশ্যই ওর মা বাবার ভূমিকা ও আছে। আর সব থেকে বড় যে সেই টুবাই সব সময় বাবার কথা শুনে চলেছে। ওদের বাবা ছেলের মধ্যে বোঝাপড়া খুব সুন্দর। টুবাই এর সব বন্ধুরা ও খুব ভালোবাসে অনিন্দ্যকে। এবং বলে কপাল করে বাবা পেয়েছে অপরাজেয়। তবে অনিন্দ্য র চলার পথটা যে এরকম হবে সেটা বোধহয় ও নিজেও কখনো ভাবেনি। পারমিতা আর অনিন্দ্য একই কলেজে পড়তো। কলেজের অ্যানুয়াল প্রোগ্রামের দিন সিনিয়র অনিন্দ্যর মঞ্চে গান গাইতে উঠে চোখ আটকে যায় হরিণ নয়না পারমিতার দিকে। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে নতুন ভর্তি হয়েছে ওদের কলেজে। অনিন্দ্যর ব্যাচের একটি মেয়ের মাধ্যমে পরিচয় তার থেকে বন্ধুত্ব। কলেজ শেষের পর বুঝতে পারে দুজনেই যে বন্ধুত্ব পরিণত হয়েছে ভালোবাসায়। দুজন দুজনকে ছেড়ে থাকতে পারবে না। অনিন্দ্য তখন একটা কলেজ ক্যাম্পাসিং এ একটা ভালো কোম্পানিতে জয়েন করেছে আর পারমিতার ফাইনাল ইয়ার। অনিন্দ্য পারমিতাকে বলে ওর পরীক্ষা হয়ে গেলে বাড়িতে বিয়ের কথা বলবে। কিন্তু পারমিতার ইচ্ছা বিয়ে টা পরে করবে। তাই অনিন্দ্য আর এগোয় না। অনিন্দ্য অফিস আর পারমিতা কলেজ সামলে নিজেদের জন্য সময় বের করে দেখা করে। এইভাবে কাটতে থাকে সময়। অনিন্দ্য এরমধ্যে একটা ব্যাপার বোঝে পারমিতা খুব উচ্চাকাঙ্ক্ষী। ও আরও পড়তে চায়,মাস্টার্সে ভর্তি হয়। পারমিতা চায় অনিন্দ্য এম বি এ করে আরও উন্নতি করুক চাকরিতে। কিন্তু অনিন্দ্য ভালোবাসে গান। তাই ও বেশি উন্নতি চায় না। বলে কি হবে বেশি উন্নতি করে , যদি নিজের মত করে বাঁচতেই না পারলাম। পারমিতা নানাভাবে বোঝায় কিন্তু অনিন্দ্য একইভাবে বলে। আসলে ছোটো থেকে গান নিয়ে বেড়ে ওঠা অনিন্দ্য গান ছাড়া ভাবতে পারে না। তাই মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেটা চাকরির ইঁদুর দৌড়ে সামিলহয় না। পারমিতা মাস্টার্স করার পর একটা খুব ভালো চাকরি পায়। এর মাঝে ওরা রেজিস্ট্রি টা করে নিয়ে ছিল। পারমিতা চাকরি পাওয়ার পর ওর বিত্তশালী বাবা যখন বিয়ের জন্য বলেন তখন পারমিতা বাবাকে সব বলে। বাবা রাজী হয় না। পারমিতা ও খুব জেদি, ও একদিন অনিন্দ্যর কাছে চলে আসে। অনিন্দ্যর মা বাবা ওকে আদর করে ঘরে তোলেন। একটা ঘরোয়া অনুষ্ঠান করে ওদের বিয়ে টা হয়ে যায়। ধনীর দুলালী পারমিতার অনেক অসুবিধা হয় ওদের ওখানে; প্রথম প্রথম মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেনি যে তা নয়। কিন্তু পার্থক্য বেশি হলে মানিয়ে নেওয়া কঠিন। পারমিতার সেরকম সমস্যা হত থাকে বিয়ের এক বছরের মধ্যে। অনিন্দ্য বুঝতে পারে তাই ও চেষ্টা করে পারমিতার জন্য একটু অন্যরকম করে ভাবতে। পারমিতা যেন এক বছরের মধ্যে হাঁপিয়ে ওঠে। ওর অভ্যাস গুলো যে অন্যরকম। ওর মত করে যাতে থাকতে পারে অনিন্দ্য সে জন্য কোম্পানির ফ্ল্যাটে চলে যায় ওকে নিয়ে।দেখতে দেখতে বিয়ের পাঁচ বছর হয়ে যায়। এমন সময় একদিন পারমিতা খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে। ডাক্তার দেখালে জানতে পারে ও মা হতে চলেছে। এই খবর শুনে অনিন্দ্য খুব খুশি হয়। ওর মা বাবাও খুব খুশি হয়। অনিন্দ্য এই খবরটা পারমিতার মাকে জানায়। ওনার সব ভুলে আনন্দে মেতে ওঠেন। কিন্তু পারমিতা খুশি হতে পারে না। ও বলে এই বাচ্চা ও চায় না। ওর কেরিয়ারের এখন উন্নতির সময় ও ঝামেলা নিতে চায় না। কিন্তু সবাই ওকে অনেক বোঝায়, আর তাতে ও রাজী হয় তবে একটা শর্তে। বাচ্চার ছমাস হয়ে গেলে আর কোনো দায়িত্ব ও নেবে না। তাতেই অনিন্দ্য রাজী হয়। অনিন্দ্য ভাবতে থাকে এ্ কোন পারমিতা! যাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল এ তো সে নয়। বাচ্চাকে দেখতে সারাদিনের আয়া রাখলো। বাচ্চার দিকে যেন পারমিতার খেয়াল নেই। ছেলের যখন দুবছর বয়স তখন কর্মসূত্রে বিদেশ চলে গেল পারমিতা। যাবার আগে শুধু বলে গেল অনিন্দ্য কে তোমার ছেলে কে তোমার মত করে মানুষ করো। সেই থেকে আজ পর্যন্ত অনিন্দ্য, ওর ছেলে টুবাই এর সব। অবশ্য ওর মা বাবা র অবদান কম নয়। পারমিতার চলে যাবার খবর পেয়ে অনিন্দ্য র মা বাবা ওর কাছে চলে আসেন নাতি কে সামলাতে। পারমিতার মা বাবা ও আসতেন। মেয়ের এই ব্যবহার ওনাদের ও কষ্ট দিয়েছিল। অনিন্দ্য ছেলেকে যখন সঙ্গীত জগতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় তখন ওর শ্বশুর মশায় আপত্তি জানায়। তারপর থেকে যোগাযোগ আবার কমে যায়। এইভাবে অনিন্দ্য র লড়াই শুরু হয়। টুবাই অর্থাৎ অপরাজেয় একটু বড়ো হয়ে যখন মায়ের কথা জানতে পারে আত্মীয়দের মাধ্যমে তখন থেকেই ও ঠিক করে জীবনে কিছু করতে হবে যাতে মা কে বোঝানো যায় বাবা সঠিক ভাবে ওকে মানুষ করেছে। পড়াশোনায় যথেষ্ট ভালো , তার সাথে বাবার মতো গান করে খুব ভালো। ও পড়াশোনার সাথে গানটাকে ও সমান গুরুত্ব দেয়। আর ওর এই কাজে সবসময় ওর পাশে থাকে ওর বাবা। তাই স্কুলে ওর সব শিক্ষকরা ওকে খুব স্নেহ করেন। ক্লাসে প্রতি বছর প্রথম হয় তার সাথে যেকোনো সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা মানেই অপরাজেয় থাকবেই আর নাম সার্থক করে আসবে পুরস্কার হাতে নিয়ে। আজকের দিনটিও সেই রকমই একটা দিন। যেখানে বিভিন্ন দেশের সঙ্গীত শিল্পীদের মধ্যে ও প্রথম হয়েছে। গত কয়েক মাস বাড়ির বাইরে থেকেছে মনপ্রাণ ঢেলে দিয়েছে এই সফলতা পাবার আশায়। আজ ও সফল হয়ে। আজ সবাই এসেছে এই অনুষ্ঠানে। নাম করা একটা চ্যানেল লাইভ দেখাচ্ছে প্রোগ্রামটা। স্টেজে যখন ওর নাম ঘোষণা করা হয় তখন অনিন্দ্যর চোখে জল আসে আনন্দ আর উত্তেজনায়। অপরাজেয় রুদ্র কে যখন কিছু বলতে বলা হয়। পনের বছর বয়সের ছেলেটা যেন হঠাৎ করেই অনেক বড়ো হয়ে ওঠে। ও বলে আজ আমি যার জন্য এই সাফল্য পেয়েছি আগে তাকে ডেকে নিতে চাই, আমার বাবা শ্রী অনিন্দ্য রুদ্রকে। যার আত্ম ত্যাগ আর আমার প্রতি বিশ্বাস আজ আমাকে এই জায়গায় পৌঁছে দিয়েছে। অপরাজেয় র সাথে স্টেজের অ্যাঙ্কর ডাকতে থাকে অনিন্দ্য কে; আর অগনিত দর্শক করতালি দিয়ে বাবা ছেলের এই সাফল্যকে অভিনন্দন জানায়। অন্যদিকে পনেরো বছর বিদেশে থেকে দুদিন আগে দেশে ফিরে যখন এই অনুষ্ঠানের কথা জানতে পারে, নিজেকে আটকাতে পারে না। অনুষ্ঠানের স্পনসর হওয়ার দরুন সূযোগ ছিল তার সদ্ব্যবহার করে এক মা যে একসময় নিজের কেরিয়ারের জন্য শিশু সন্তান কে ফেলে বিদেশে পাড়ি দিয়ে ছিল। আজ অনুষ্ঠানের শেষে যখন সবাই বাবা আর ছেলেকে অভিনন্দন জানাচ্ছে তখন কর্মজীবনে সফলতার শিখর ছুঁয়েও ভীষণভাবে নিঃসঙ্গ, হতাশাগ্রস্ত পারমিতা চোখ ভর্তি জল নিয়ে একা নিজের গাড়িতে ওঠে। আজ চাইলেও আর যেতে পারে না নিজের ফেলে আসা ঘরে। তবে এটা আজ পারমিতা নিজের কাছে স্বীকার করে যে অনিন্দ্য ঠিক ছিল আর আজও ওই সঠিক। ও ঠিকই বলত যে সফলতা তাকেই বলে যে কাজ করে আমি এবং আমাকে ঘিরে থাকা সবাইকে খুশি করতে পারব। অর্থ আর ক্ষমতাই সব নয়। অর্থবান আর ক্ষমতাবান মানুষের চারপাশে অনেকে থাকে কিন্তু কেউ নিঃস্বার্থ ভাবে থাকে না। একটা সময় বুঝতে পারে যে সে বড্ড একা। আজ পারমিতা কর্মজীবনে উন্নতির শিখরে পৌঁছিয়েছে ঠিকই কিন্তু ও আজ খুব একা। আজ ভাবে একটা সুন্দর সুখী জীবন তো পেতে পারত; আজ ও সন্তান গর্বে গর্বিত হতে পারত, সে ও নিজের হাতে বন্ধ করে দিয়েছে। খুব ইচ্ছা হচ্ছে আজ ছেলেটাকে একবার বুকে জড়িয়ে ধরতে। ফোনটা বের করে কল করে একটা -- আমাকে অপরাজেয় রুদ্র রায় নম্বর টা হোয়াটসঅ্যাপ করো। মূহুর্তে টুং করে নম্বর টা এসে যায়। একমূহূর্ত ভাবে তারপর লেখে অনেক বড়ো হও, বাবার মুখ উজ্জ্বল করো। খুব ভালো থেকো।লিখে পাঠাবে কিনা ভাবে। তারপর------একটা ছোট্ট উত্তর আসে------ অনেক ধন্যবাদ।বাবার নামই উজ্জ্বল করার চেষ্টা করছি। আমার বাবা একাই একশো। ভালো থাকবেন।